শিক্ষায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান সম্পর্কে লেখ। বর্তমান ভারতীয় সমাজে এর প্রাসঙ্গিকতা সম্বন্ধে লেখো

শিক্ষায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান সম্পর্কে লেখ । বর্তমান ভারতীয় সমাজে এর প্রাসঙ্গিকতা সম্বন্ধে লেখো। Marks-8

মহাজীবন:-

ঊনবিংশ শতক নবজাগরণের যুগ। রামমোহনের সাথে এই জাগরণের কর্মযজ্ঞে যোগ দিলেন অখন্ড পৌরুষের জীবন্ত বিগ্রহ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। অধুনা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে ১৮২০ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মাতা ভগবতী দেবী। গ্রামের পাঠশালার পাঠ শেষ করে ১৮২৯-এ সংস্কৃত কলেজ, এরপর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে অধ্যাপনা, পরে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ এবং পরে স্কুল পরিদর্শক হিসেবে কার্যভার চালিয়েছিলেন। নবজাগরণের পটভূমিতে তাঁর শিক্ষাচিন্তা ও শিক্ষাসংক্রান্ত কার্যাবলি, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষার সংমিশ্রণ- এসবের ফলশ্রুতি হিসেবে ইংরেজি শিক্ষা, যুক্তিবাদী চিন্তাভাবনা, মানবতাবোধের বিস্তার, নারীশিক্ষা, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাভাবনা, জীর্ণ সংস্কারের বিরুদ্ধে জেহাদ প্রভৃতি মূর্ত হয়ে উঠল।

শিক্ষাচিন্তা:-

তাঁর শিক্ষাচিন্তা বিভিন্ন গতিপথে প্রবাহিত হয়েছিল। তিনি হাতে কলমেও তারপর ঘটিয়েছিলেন। তাঁর শিক্ষাচিন্তাকে বিশ্লেষণ করে আমরা যে দিকগুলো খুঁজে পায় তা নিম্নরূপ-

১. প্রাথমিক শিক্ষা:-

প্রাথমিক শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের অবদান শিক্ষার ইতিহাসে একটি নতুন যুগ সূচিত করে। ১৮৫৩ সালে প্রাথমিক শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করে বেশকিছু প্রস্তাব সম্বলিত একটি প্রতিবেদন লর্ড ডালহৌসির নিকট পেশ করেন। প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর শিক্ষাচিন্তার প্রতিফলন হয় এইভাবে-

ক. শিক্ষার মাধ্যম:-

বিদ্যালয়গুলিতে মাতৃভাষার মাধ্যমে পাঠদান করা হবে।

খ. পাঠ্যসূচি:-

প্রারম্ভিকভাবে লেখাপড়া, গাণিতিক হিসাব, ভূগোল, ইতিহাস, পাটিগণিত, জ্যামিতি, বিজ্ঞান প্রভৃতি। এছাড়াও শরীরতত্ত্ব, রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রভৃতির শিক্ষাদান।

গ. মডেল স্কুল:-

তিনি তিন থেকে পাঁচ ক্লাসের মডেল স্কুলের কথা বলেন। স্কুলে একজন হেডপন্ডিত ও দুজন সহকারী পন্ডিত থাকবেন বলা হয়। তিনি চেয়েছিলেন হুগলি, বর্ধমান ও মেদিনীপুরে মাধ্যমিক স্কুলগুলি থেকে দূরে এগুলি স্থাপিত হবে।

ঘ. বিদ্যালয় পরিদর্শন ব্যবস্থা:-

তাঁর চিন্তায় দুটি করে জেলা একজন পরিদর্শকের হাতে থাকবে। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ প্রধান পরিদর্শক হিসাবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পাবেন।

ঙ. শিক্ষক শিক্ষণ:-

শিক্ষক শিক্ষণ এর জন্য তিনি নর্মাল স্কুল স্থাপনের কথা বলেন। তা বাস্তবায়িতও হয় ১৮৮৫ সালে বর্ধমান, হুগলি, মেদিনীপুর ও নদিয়ায় পাঁচটি করে এরূপ বিদ্যালয় স্থাপনের মধ্য দিয়ে।

চ. পাঠ্যপুস্তক:-

তিনি প্রাথমিকে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য নিজেই বেশ কিছু বই রচনা করেন। এই বইগুলি শিশু মনস্তত্ত্বকে উপলব্ধি করেই লেখা। আজও অমর হয়ে আছে বর্ণপরিচয়। এছাড়াও বাংলার ইতিহাস, চারুপাঠ, জীবনচরিত-এগুলিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।

২. শিক্ষার লক্ষ্য:-

বিদ্যাসাগরের মতে ভারতীয় শিক্ষার লক্ষ্য হল- ‘‘সংস্কৃত ও ইংরেজি জ্ঞানের উপর পর্যাপ্ত অধিকার অর্জন করা এবং তার দ্বারা এমন সব মানুষ তৈরি করা, যারা আমাদের পাশ্চাত্য জগতের সভ্যতা ও বিজ্ঞানের দ্বারা আমাদের মাতৃভাষাকে সমৃদ্ধ করতে সমর্থ হবে।’’এই লক্ষ্যে তার সংস্কৃত কলেজের সংস্কারের মূল লক্ষ্য হয়েছিল-সহজ-সরল বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতির সাহায্যে সংস্কৃত শিক্ষার উন্নতি, প্রাচীন গানের সাথে আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞানের সমন্বয়, মারতি ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য সাহিত্য-বিজ্ঞানের শিক্ষা দিতে পারার সামর্থ্য অর্জন। তিনি ১৮৫১-১৮৫৮ সাল পর্যন্ত সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীন বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সাধনের সক্ষম হয়েছিলেন।

৩. গণশিক্ষা:-

তিনি ছিলেন দয়ারসাগর তার মানবতাবোধ তাকে এক উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। সে বোধ থেকেই তিনি ভারতবর্ষে গন শিক্ষার প্রসারে প্রেরণা লাভ করেন। তিনি চাননি শিক্ষাযর ফসল মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ ঘরে তুলুক। তিনি বলেছিলেন- ‘‘আজ জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের প্রয়োজন, আমাদের উচিত কতগুলি মার্তৃভাষাভিত্তিক বিদ্যালয় স্থাপন করা এবং মাতৃভাষায় প্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তক রচনা করা। আমাদের উচিত এমন একদল লোককে শিক্ষিত করে তোলা যারা শিক্ষকতার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।’’
বাস্তবে তাঁর এই চিন্তা তাঁকে অনেকগুলি বিষয়ের বাস্তবায়ন ঘটাতে চালিত করে। তিনি অব্রাহ্মণ ছাত্র দের জন্য সংস্কৃত কলেজের দীর্ঘদিনের বন্ধ দুয়ার খুলে দেন। সর্বসাধারণের জন্য পাঠ্যপুস্তক রচনা ও প্রকাশের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। শিক্ষাক্ষেত্রে মেকলে'র চুঁইয়ে পড়া নীতি'র তীব্র বিরোধিতা করেন। পরে অবশ্য লর্ড ডালহৌসি ও হ্যালিডে সাহেবের সহযোগিতায় তাঁর জনশিক্ষার প্রচারের প্রচেষ্টা অনেকখানি সফলতা পায়।

৪. স্ত্রী শিক্ষা:-

ঊনবিংশ শতাব্দীর নারী প্রগতি ও বিদ্যাসাগর- এই দুটি প্রায় সমর্থক হয়ে ওঠে বিদ্যাসাগরের স্ত্রী শিক্ষা সম্পর্কিত চিন্তাভাবনা ও বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে। ১৮৪৯ সালের মে মাসে বেথুন সাহেবের সহযোগিতায় মেয়েদের শিক্ষার জন্য একটি অবৈতনিক স্কুল স্থাপিত হয়, ১৮৫০ সালের ডিসেম্বরে বিদ্যাসাগর ওই স্কুলের অবৈতনিক সম্পাদকের পদ গ্রহণ করেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি বহু বান্ধব ও পরিচিতগণকে তাদের কন্যাদের এই স্কুলে পড়ার অনুরোধ জানাতে থাকেন। বহু বিখ্যাত ব্যক্তি তাঁর এই অনুরোধে সাড়াও দেন। তার নির্দেশে বেথুন স্কুলের গাড়ির পাশে লেখা হয়েছিল- ‘‘কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষানীয়াতি যত্নতঃ’’(পুত্রের মত যত্ন করে কন্যাকেও পালন করতে হবে ও শিক্ষা দিতে হবে)। স্ত্রী শিক্ষিত ও জ্ঞানসম্পন্ন হলে শিশু সন্তানকে শিক্ষা দিতে পারবেন। স্ত্রী ও কন্যাগণের মনোবৃত্তি প্রকৃতরূপে মার্জিত হলে সকল কার্যের অনুষ্ঠান সুচারুরূপে সম্পাদিত হবে।

৫. উচ্চ শিক্ষা:-

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ও তাঁর চিন্তা-ভাবনা ও কর্মকান্ড যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন বিদ্যাসাগর। এক সময় এর ফেলো নিযুক্ত হন। এরপর Calcutta Training School (Metropolitan Institution)- এর সম্পাদকও হয়েছিলেন। তখন এটি ছিল একমাত্র অনুমোদিত উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র। এর আর্থিক সংকটের সময় নিজের প্রায় সব ব্যয়ভার বহন করতেন। ১৮৭০ সালে তিনি Indian Association for the Cultivation of Science-এর সাথে যুক্ত হন। পরে এর ট্রাস্টি সদস্যও হন। 

৬. বাংলা ভাষা সাহিত্য ও গণমাধ্যম:-

বাংলা সাহিত্যের বিকাশ সাধনে তাঁর দান অসামান্য। জনগণের সুবিধার জন্য বর্ণমালার সংস্কারসাধন, বাংলা গদ্য সাহিত্য সৃষ্টি, প্রাথমিক শিক্ষার একাধিক আদর্শ পুস্তক রচনা, বাংলা গদ্যে যতিচিহ্নের ব্যাপক প্রয়োগের দ্বারা তাকে সহজবোধ্য করে তোলা, বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ প্রকৃতির ছিল অনন্য শিক্ষা চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কাকে ‘বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

• উপসংহার

আধুনিক শিক্ষার ইতিহাসে পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মধ্যাহ্ন সূর্যের মত দেদীপ্যমান। পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য ঐতিহ্যের মধ্যে সমন্বয় ও সংশ্লেষ সম্ভব তা তিনি প্রমাণ করে যেতে পেরেছিলেন। শিক্ষার প্রতি অধিক তাঁর ছোঁয়ায় হয়ে উঠেছিল উজ্জ্বল। তাঁর একাগ্রতা, নিষ্ঠা নিঃস্বার্থ মনোভাব, গভীর দূরদৃষ্টি ভারতীয় শিক্ষাকে বসেছিল সুমহান মর্যাদার আসনে। মাইকেল মধুসূদনের কথায়- ‘‘He has the genious and wisdom of an ancient sage, the energy of an Englishman and the heart of a Bengalee mother’’ আর এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন- বাংলার নতুন সাংস্কৃতিক ভাবধারার ভগীরথ।




Post a Comment

0 Comments