স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সমাজের বৈশিষ্ট্য গুলি উল্লেখ করো।এই গ্রামসমাজ ধ্বংসের কারণ গুলি কী কী। দ্বাদশ শ্রেণীর সমাজবিজ্ঞানের ভারতীয় সমাজ: কাঠামো ও প্রক্রিয়া অধ্যায়ের (বিশদ উত্তরধর্মী / বিশ্লেষণধর্মী) প্রশ্নের উত্তর। Marks-8 Important question of Sociology in class 12
স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সমাজের বৈশিষ্ট্য :
স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সমাজকে উদ্ভব, বিকাশ ও স্থায়ীত্ব ইতিহাস দীর্ঘদিনের। এত সময় ধরে টিকে থাকার পেছনে এর জন্য কিছু প্রধান ভূমিকা খুঁজে পাওয়া যায়। এই উপাদানসমূহ বিষয়গুলি দেখলে এর সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা লাভ করা সম্ভব। এগুলির সম্বন্ধে নিম্নে আলোচনা করা হল -
(১)
এই গ্রাম সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো বাজার বিহীন অর্থনীতি যেখানে বিনিময় প্রথার মাধ্যমে চাহিদা, উৎপাদন ও যোগান অর্থনৈতিক উপাদান গুলির মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকতো। উৎপাদনশীল জাতিগুলির মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় থাকত। এই প্রসঙ্গকে উল্লেখ করে এস. সি. দুবে. এই বাজারের অর্থনীতিকে মেনে নেননি। তাঁর মতে, “বাজার হাটে একাধিক গ্রাম থেকে ক্রেতারা আসত। বাজারের স্থান হিসেবে গ্রামের এমন একটি স্থানকে বেছে নেওয়া হত, যেখানে কাছাকাছি অন্য গ্রাম থেকে সহজেই লোকজন আসতে পারে”।
(২)
সেই সময় গ্রামীণ অর্থনীতিতে দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে যজমানি প্রথার গুরুত্ব ছিল।
(৩)
জমি সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় যেমন জমির সংরক্ষণ, বন্টন, রাজস্ব সংগ্রহ এবং পাশাপাশি গ্রামের আইন,বিচার, শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে গ্রাম পঞ্চায়েতের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পঞ্চায়েতই স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন কর্তৃপক্ষ হিসেবে কাজ করতে হত।
(৪)
এ সময় জমির উপর ব্যক্তিগত মালিকানা বিষয়টি গড়ে ওঠেনি। জমির যৌথ মালিকানা ছিল। কার্ল মার্কসও এটিকে সমর্থন জুগিয়েছেন। ফলে জমির মালিকানা নিয়ে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ মাথাচাড়া দিতে পারেননি অনেকেই মনে করন উৎপাদিত কৃষিপণ্য পরিবারপিছু কর্মীসংখ্যা ভিত্তিক সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য বহন করে।
(৫)
গ্রাম অঞ্চলের আদিবাসীরা বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীতে বিভাজিত ছিল এবং তাদের পেশা, সুযোগ-সুবিধা, ভূমিকা, মর্যাদা, সীমাবদ্ধতা - এসবই এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। তবে স্বয়ংসম্পূর্ণতার ক্ষেত্রে এর একটা ইতিবাচক দিক ছিল। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন জাতি অনুযায়ী পূর্ব নির্ধারিত থাকায় উৎপাদন, ও বিনিময় প্রথার মাধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকতো।
(৬)
ভারতীয় ব্রাহ্মসমাজ গুলিতে ধর্মের প্রভাব ছিল সব থেকে বেশি। একদিকে যেমন এর ইতিবাচক প্রভাব ছিল, ঠিক তেমনি অন্যদিকে বেশ কিছু নেতিবাচক প্রভাব দেখা যায়। গ্রামাঞ্চলের মানুষদের প্রায় সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হত ধর্মবোধ দ্বারা। আর এর থেকে জন্ম নিয়েছিল কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, ঐতিহ্যের প্রতি আনুগামিতা, রক্ষণশীলতা ও সংকীর্ণতা যা অনেকাংশে সমাজের প্রগতির পরিপন্থী।
(৭)
এই সময় কৃষি বা কুটির শিল্পোৎপাদন ছিল প্রযুক্তিবিহীন ও গতানুগতিক। এবং উৎপাদন ছিল নিম্নমানের। আবার শ্রমবিভাজনও অনুপস্থিত ছিল। উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল কঠোরভাবে জাতিভিত্তিক। এইসব কারণে কোনো ব্যক্তিগত প্রয়াস, ও পেশাগত বৈচিত্র, উৎপাদিত দ্রব্যের গুণগত এবং পরিমাণগত মান বৃদ্ধির - এই সবকিছুই স্থবির হয়েছিল।
(৮)
বিচ্ছিন্নতা বিষয়টি এই জাতীয় গ্রাম সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যেহেতু গ্রামীণ জনসম্প্রদায়ের সদস্যদের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থায় গ্রামই করতো, তাই বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগের তেমন কোনো প্রয়োজন বোধ গ্রামবাসীদের ছিল না। আবার যোগাযোগ ব্যবস্থাও তেমন কিছু ছিল না।
(৯)
গাঙ্গুলী খন্ড খন্ড প্রজাতন্ত্র ও পরস্পর বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে সামগ্রিক জাতীয় চেতনা বা সমগ্র ভারত রাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদী চেতনা গ্রামবাসীগনের মধ্যে ছিল না। এইরূপ চেতনাহীনতার কারণে ভারতের সামাজিক পরিবর্তন ও অগ্রগতি দীর্ঘদিন আটকে ছিল।
(১০)
গ্রাম সমাজের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য হলো জনসম্প্রদায়গত মানসিকতা। এটিকে গভীর আমরা-বোধ, সুদৃঢ় বন্ধন, একতা প্রভৃতি নানা ভাবে দেখা যেতে পারে। বাস্তবিকই, এক একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সমাজের অধিবাসীগণের মধ্যে গভীর ঐক্য ও সম্প্রীতি বর্তমান ছিল। এই সম্পর্কের গভীরতা তৈরি হওয়ার পিছনে অনেকগুলি উপাদান কাজ করে, যেমন - ক্ষুদ্র পরিসরে সকলের সহাবস্থান, সামাজিক রীতিনীতি, আচার-আচরণ প্রথার অভিন্নতা, উৎপাদিত দ্রব্যের উপর সবের সমান অধিকার, যৌথ মালিকানার ধারণা, প্রতিবেশীসুলভ মানসিকতা, গ্রাম্য ঐতিহ্যের প্রতি বংশপরম্পরাগতভাবে শ্রদ্ধা প্রদর্শন, বিনিময় প্রথার মাধ্যমে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, সমধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা প্রভৃতি। ফলস্বরূপ দেখা যায়, এই ভারতবর্ষে বহুবার শাসক পরিবর্তন হলেও গ্রাম সমাজের মধ্যে ঐক্য বিঘ্নিত হয়নি, আবার পরিবর্তের খুব বেশি প্রভাবও পড়েনি।
(১১)
প্রাক্-ব্রিটিশ সময়ের গ্রামগুলিতে স্থানীয় চাহিদার কথা মাথায় রেখে জাতিভিত্তিক বিভিন্ন পেশার লোকজন বিভিন্ন দ্রব্য উৎপাদন করতো। এই উৎপাদন বা সেবার পরিশ্রমিক অনেকাংশে সময় মেটানো হত দ্রব্যে। ডি.ডি. কোশাম্বীর মতে, ‘‘দ্রব্য বা পণ্য রাষ্ট্রের হাতে না পৌঁছানো পর্যন্ত তা বাজারপণ্যের রূপ পায়নি’’।
(১২)
আজকের প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ওই সময় কৃষি ও শিল্পের সহাবস্থান ও মেলবন্ধন। কাল মার্কসের মতে “কৃষি ও শিল্পের মেলবন্ধন এর ফলে ক্ষুদ্র সমাজ সম্পূর্ণরূপে স্বয়ম্ভর হয়” বর্তমান সমাজে যার দিশানুসন্ধানে অনেকেই নিয়োজিত।
• এইভাবে দেখা যায়, প্রাক্-ব্রিটিশ ভারতে গ্রাম সমাজের স্বয়ংসম্পূর্ণতা বিষয়টি কোন একটি নির্দিষ্ট উপাদানে বাধা ছিল না। এটি ছিল আর্থিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, জাতিভিত্তিক, সামাজিক উপাদানসমূহের জটাজাল বিশেষ।
স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সমাজ ভাঙনের মূল কারণ :
• ব্রিটিশ চক্রান্ত :
সপ্তদশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের চক্রান্তের শিকার হয় ভারতীয় গ্রামসমাজগুলি। ইউরোপে ততদিনে শুরু হয়ে গেছে সামন্ততন্ত্রের অবসানে ধনতন্ত্রের পথ চলা। ভারতবর্ষেও ধনতন্ত্রের অন্তর্ভুক্তির চেষ্টায় প্রথমেই বাধা হয়ে দাঁড়াল এই গ্রাম সমাজের স্বয়ংসম্পূর্ণতা। কারণ এখানে তখন প্রয়োজনভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা চালু ছিল, ছিলনা উদ্ধৃত্ত - যা থেকে তৈরি হয় পুঁজি ধনতন্ত্রের মূলধন। তারা নতুন ভূমি সংস্কার ব্যবস্থা চালু করে যার ফলে ভাঙতে থাকে গ্রাম সমাজের সংকীর্ণ কাঠামো। তাদের সুপরিকল্পিত ভূমি সংস্কার নীতির হাত ধরে ভূস্বামী ও মহাজন শ্রেণীর আবির্ভাব হয়।
বিভিন্ন নীতি :
১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নীতি রাজস্ব আদায়কারী জমিদারকে জমির মালিক হিসাবে প্রতিষ্ঠা দেয়। ১৮২২ সালে মহলওয়ারি বন্দোবস্তে একটি গ্রাম বা মহলকে রাজস্ব আদায়ের একক ধরা হলে কৃষকের জীবনে সর্বনাশ নেমে আসে। নিয়মিত রাজস্ব প্রধানের শর্তে, সরাসরি কৃষককে কুড়ি থেকে ত্রিশ বছরের জন্য জমির স্বত্ব প্রদানের মধ্য দিয়ে। এক্ষেত্রে সরকারি কর্মীরা অত্যাচারী হয়ে উঠত।
ফলশ্রুতি :
যাই হোক মূল কথা এটাই যে এই সকল আইনের দ্বারা ব্রিটিশ তার ঔপনিবেশিক শক্তির বৃদ্ধি ঘটেছিল, পুঁজিবাদী ধনতান্ত্রিক উৎপাদনব্যবস্থার লক্ষ্যে। আশ্চর্যজনকভাবে তাদের এই আইনগুলি সমগ্র ভারতে প্রযোজ্য ছিল না।
এই সকল নীতির ফলে যা যা পরিবর্তন সূচিত হয়, সংক্ষিপ্তাকারে সেগুলো নিম্নরূপ-
১. জমির গ্রামভিত্তিক মালিকানার পরিবর্তে ব্যক্তিগত মালিকানা সৃষ্টি।
২. জমির ওপর বংশপরম্পরায় ভোগ দখলের অধিকারের বিনাশ।
৩. জমির নিয়ন্ত্রণ গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে রাষ্ট্রের হাতে চলে যাওয়া।
৪. বনভূমি ও বনজ সম্পদের জন্য কর প্রদানের সূচনা।
৫. কৃষি ও কুটির শিল্পের বিচ্ছেদ।
৬. ক্ষুদ্র চাষীদের ভূমিদাসে পরিণত হওয়া।
৭. কৃষকরা শোষণের শিকার হয়ে যাওয়া।
৮. গ্রামগুলির প্রতিটি বিষয়ে রাষ্ট্রশক্তির হাতে চলে যাওয়া।
৯. গ্রাম পণ্যের জিনিসগুলি বাজার পণ্যে রূপান্তরিত হওয়া।
• সর্বোপরি বলা যেতে পারে, রাষ্ট্রশক্তির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্রিয়াকলাপের চাপে গ্রামের সেই পারস্পরিক সুদৃঢ় ও বন্ধন নষ্ট হয়ে গিয়ে তার স্বয়ংসম্পূর্ণতার উপাদানগুলি পরাভূত হয়েছিল।
0 Comments